হায়দারের দেশ, আমার দেশ
হিন্দুশাস্ত্র বলেছে পুং নামক নরক থেকে উদ্ধার করে যে, সে-ই হল পুত্র। কিন্তু
ভূস্বর্গপ্রতিম নরক থেকে উদ্ধার করা কোন্ পুত্রের পক্ষে সম্ভব? তাছাড়া
হিন্দুশাস্ত্রের বিধান বিধর্মীদের বেলায় খাটে কিনা সেটাও গুরুতর প্রশ্ন। খাটলেও সবার
উপরে AFSPA (Armed Forces’ Special
Powers Act) সত্য তাহার উপরে নাই। অতএব যখনই হায়দারের বাবা
নিরুদ্দেশ হয়েছেন তখনই তো বোঝা গেছে তাঁর আদরের পুত্রটি যতবড় তালেবরই হোক না কেন,
সে এসে বাবাকে উদ্ধার করতে পারবে না, তাঁর পরিণতি যা হবার তা-ই হবে। প্রত্যাশা
বাবারও ছিল না। তাই তো এলাকার সুপরিচিত শ্রদ্ধেয় ডাক্তারবাবু সন্দেহভাজন নাগরিকের
আলখাল্লায় পরিচয়পত্র হাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলে যান হায়দারের জন্য
ঈশ্বর আছেন, তিনিই থাকবেন। অর্থাৎ বোঝা গেল ‘রোজা’ সুলভ নিরুদ্দেশ লোকটিকে খুঁজে
বেড়ানোর রোমাঞ্চ আমাদের জন্য অপেক্ষা করে নেই।
কি করে বুঝলাম নেই? কি যে
বলেন! এটা ২০১৪। খোঁজখবর না নিয়ে, দু-একজন ফিল্মপন্ডিতের লেখাপত্র না পড়ে কি আর পয়সা
খরচা করে দেখতে গেছি ছবিটা?
না। হলে যে জনাকুড়ি দর্শক
ছিল তারা সবাই মোটেও অতসব জেনে যায়নি। তার প্রমাণ ডঃ মীর যখন মিলিটারির মুখঢাকা
খোঁচড়টির সামনে দাঁড়িয়ে, তখন সোচ্চার প্রার্থনা “চিনিস না, চিনিস না”। তবুও সকলেই
বুঝলেন যে ডঃ মীর আর ফিরবেন না। কারণ অবচেতনে আমরা সকলেই জানি, উগ্রপন্থীরা ধরে
নিয়ে গেলে তবু ফিরে পাওয়ার আশা আছে, পুলিশ বা মিলিটারির বিষনজরে পড়লে কেউ ফেরে না।
ডঃ মীর আমাদের অচেনা হতে পারেন, ভিখারী পাসোয়ান তো অচেনা নয়।
দেশপ্রেম ব্যাপারটা ভারী
গোলমেলে। আমি পশ্চিমবঙ্গবাসী, স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে বেশ একটু আত্মশ্লাঘা
আছে, কাশ্মিরীদের মত ভারত আমার উপরে শোষণ চালাচ্ছে এরকমও মনে হয়না চট করে। অথচ যে
লোকটাকে স্পষ্ট দেখলাম ভারতবিরোধী যোদ্ধার প্রাণ বাঁচাচ্ছে তার বাড়িটা উড়ে গেল
দেখে আমার বেশ রাগ হল। এমনকি লোকটাকেও মানবতাবাদী বলেই মনে হচ্ছিল। কি আপদ বলুন
দেখি!
লেনিন নাকি অনেক ঝানু
কমরেডের মতামত অগ্রাহ্য করে আইজেনস্টাইনের ছবির জন্য টাকা বরাদ্দ করেছিলেন।
যুক্তিটা ছিল এই যে ফিল্ম যা পারে তা হাজারটা বক্তৃতাও পারে না। ‘হায়দার’ দেখার
পরে এটা অকাট্য যুক্তি বলেই মনে হয়। অরুন্ধতী রায় কাশ্মিরীদের উপর অন্যায় নিয়ে
যতবার লেখেন ততবার দেশদ্রোহী আখ্যা পান, মহিলা বলে ধর্ষণের হুমকিও শোনেন। অথচ ঐ যে
দু ঘন্টা চল্লিশ মিনিট হিন্দুরাষ্ট্র হতে চাওয়া দেশের মূল ভূখন্ডের আমরা কয়েকজন প্রথমে
হিলাল মীরের জীবনভিক্ষা করলাম নিজ নিজ ঈশ্বরের কাছে, তারপর চাইলাম হায়দার তার
ভারতবন্ধু কাকাকে খুন করুক, প্রতিশোধ নিক বাবার হয়ে, এ কি ফিল্ম ছাড়া কোনকিছুর
দ্বারা সম্ভব হত? আবার হল থেকে বেরিয়ে দিব্য বাড়ি চলে এলাম, একবারও নিজেকে
দেশদ্রোহী মনে হলনা কিন্তু। অন্য কেউও তেমন অভিযোগ করে গ্রেপ্তার টেপ্তার করেনি এপর্যন্ত।
যখন হায়দার আমাদের সবাইকে
চমকে দিয়ে তার সবচেয়ে ঘেন্নার মানুষটাকে জীবনযন্ত্রণা ভোগ করার জন্য ছেড়ে দিল তখন
তো একটা বিরাট চড় এসে পড়ল আমার গালেও কারণ আমিও তো বিড়বিড় করছিলাম “চালা, গুলিটা
চালা”। অ্যারিস্টটল তো বলেছিলেন ট্র্যাজিক নায়কের কষ্টভোগের মধ্যে দিয়ে আমারও
কষ্টভোগ এবং ফলতঃ পাপস্খালন। ‘Hamlet’ দেখে
তাই-ই তো হয়। কিন্তু বিশাল ভরদ্বাজ কি ঠিক তা ঘটালেন? ট্র্যাজিক নায়ক যখন তার
ট্র্যাজেডির ঊর্দ্ধে উঠে নতুন পথের সন্ধান দিয়ে যায়, কী বলে তাকে? Catharsis শব্দটা কি ধরতে পারে সেইসময়ে দর্শকের অপরাধবোধকে?
বয়ঃসন্ধিকালে দেখেছিলাম
সেই ছবিটা --- সেখানেও একটা খোঁজ ছিল; সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী খুঁজে বেড়াচ্ছে অপহৃত
স্বামীকে সেই কাশ্মীরেই। কি খারাপ সেখানে কাশ্মীরের লোকগুলো। গোটা রাজ্যটায় ভালো
মানুষ বলতে শুধু এক মন্দিরের পুরুত আর একটা অবলা মেয়ে। বাকি সবাই AK ৪৭ চালায় আর জাতীয় পতাকা পোড়ায়, এবং নামাজ পড়ে। কি
মজা! কত সোজা ছবি। কিচ্ছু ভাবতে টাবতে হয় না। বেশিরভাগ লোক যেমনভাবে কাশ্মীরকে
ভাবে ঠিক তেমনই দেখানো। ছবিটা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৫ তে। ‘হায়দার’ আমাদের ঐ সময়েরই
গল্প বলছে। মানে কাশ্মীরকে কাশ্মীরের চোখ দিয়ে দেখতে আমাদের সময় লাগল দু দশক। এ বড়
ভয়ঙ্কর ট্র্যাজেডি; এর কাছে ‘Hamlet’ শিশু।
অথচ আমাদের দাবী হল কাশ্মীরিরা যেন এদেশটাকে নিজের ভাবে, গলা ছেড়ে “জয় হিন্দ” বলে।
Chutzpah বটে।
হায়দার আলিগড়
বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের ছাত্র ছিল। কবিতাও লিখত। তার হাতে কি কোনভাবে এসে পড়েছিল
নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’? সে জন্যই কি সে জন্মভূমিকে
প্রচলিত নামে সম্বোধন না করে পছন্দের নামে ইসলামাবাদ বলে ডাকে? আমাদের সকলেরই তো
বড় আদরের বড় ব্যক্তিগত বাবা-মায়ের বিছানাটা, বাবার চেয়ারটা, বাবার প্রিয় গানটা,
বাড়িটা, পাড়াটা। সেইজন্যেই দেশটা। যার সেগুলো হারিয়ে যায় সে তো ঈশ্বর আর সীতার মত
দেশ খুঁজে বেড়ায় আজীবন।
যত সজোরে দেশপ্রেম ঘোষণা
করছি আমরা আর অন্যের দেশপ্রেম দাবী করছি তত কি দেশটা হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের? হায়দার
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমা করতে চেষ্টা করেছে। মহাত্মা গান্ধী নামে এক দেশদ্রোহী
ট্র্যাজেডি কাটিয়ে ওঠার ওরকমই একটা পথ বাতলেছিলেন বটে দাঙ্গায় সন্তান হারানো এক
হিন্দু বাবাকে --- “প্রতিশোধ ভুলে যাও, একটা অনাথ মুসলিম বাচ্চাকে দত্তক নাও।” সেই
যে রিচার্ড অ্যাটেনবরোর ছবিটায়।
ওহো! সে তো আবার একটা
ইংরেজ। ওর দেশের বিরুদ্ধেই তো আবার আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। বোঝো কান্ড! এ তো
দেখছি দেশ ব্যাপারটাই বেশ গোলমেলে!
*এটা ফিল্ম রিভিউ নয়। ওটা
লেখার বিদ্যে আমার নেই, এক্ষেত্রে উদ্দেশ্যও ছিল না।