Sunday, November 3, 2013



দেবতার জন্ম


 বের্টোল্ট ব্রেখটএর 'গ্যালিলিও' নাটকে এক সংকটমুহূর্তে তাঁর শিষ্য বলেন "হে ঈশ্বর, দেশ বড় দুর্ভাগা I এখানে একজনও নায়ক নেই I " প্রাজ্ঞ এবং নির্যাতিত মানুষটা উত্তরে বলেন  "দুর্ভাগা সেই দেশ যে দেশের একজন  নায়কের প্রয়োজন হয় I" 
কলকাতায় এই নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার সময় আমার জন্ম হয়নি I কিন্তু বাবা-মা এবং পরবর্তীকালে শিক্ষকদের মুখে শোনা সংলাপ বারবার মনে পড়ে যখনই বোঝবার চেষ্টা করি কেন শচীন তেন্ডুলকার শুধুমাত্র একজন অসাধারণ ক্রিকেটার না হয়ে দেবতা হয়ে উঠলেন আপামর ভারতবাসীর কাছে
এই ব্লগারের, পাঠকের আর শচীনের যে দেশে জন্ম তা যে দুর্ভাগা নিয়ে আশা করি বিশেষ বিতর্কের প্রয়োজন নেই I  
১৯৮৯ যখন শচীনের আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় তখন স্বাধীনতার পর ৪২ বছর অতিক্রান্ত অথচ দেশের একটা বড় অংশের মানুষ পরিষ্কার পানীয় জল পান না, পেট ভরে খেতে পান না তো অনেকেইউপরন্তু রাজীব গান্ধীর সরকার অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের তালা খুলিয়ে দিয়েছেন ; দেশ আরো একবার সাম্প্রদায়িক বিভাজনের দিকে এগোচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নিজে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে অভিযোগ উঠেছে I এমন একটা সময়ে এই দুর্ভাগা দেশের তো একজন নায়ককে দরকার ছিলই
শচীনের টেস্ট অভিষেক ১৫ নভেম্বর ১৯৮৯, আর সে বছর সাধারণ নির্বাচন শুরু হয় ঠিক এক সপ্তাহ পরে --- ২২ নভেম্বর I নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় লোকসভা ত্রিশঙ্কু I সেই থেকে ১৯৯১ এর আগে পাঁচ বছরের স্থিতিশীল সরকার হয়নি I এই সময়ে ভারতীয় ক্রিকেট দলও প্রায় কিছুই জেতেনি, নেতাদের মধ্যে জনগনমনয়ধিনায়ক স্পষ্টতঃই ছিলেন না I অথচ দেখা গেল ভাল করে দাড়ি গোঁফ না গজানো একটা ছেলে পাকিস্তানের জোরে বোলারের নাক ফেটে গেলেও পরের বলে চার মেরে দিল (শিয়ালকোট, ১৯৮৯), নিউজিল্যান্ডে দাঁড়িয়ে রিচার্ড হেডলির দলের সাথেও প্রায় শতরান করে ফেলছিল (নেপিয়ার, ১৯৯০),  ইংল্যান্ডের মাঠে ইনিংস হার বাঁচাল (ওল্ড ট্র্যাফোর্ড, ১৯৯০) I বয়সে যে নিতান্তই বালক তার এইসব কান্ডের পরে দুর্ভাগা দেশের নায়ক হয়ে যাওয়া বোধহয় নেহাত অপ্রত্যাশিত নয় I 
দুধের শিশুর প্রতিভায় আলোকিত হওয়ার ব্যাপারটা এদেশে সুপ্রাচীন I কৃষ্ণের কংসবধের গল্প দিয়ে শুরু I "ধর্ম সমাজের আফিম" --- কার্ল মার্কস বলেছিলেন I আর ক্রিকেটকে তো ভারতবর্ষে ধর্মের জায়গাই দেওয়া হয়েছে আজকাল I জনমানসে প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছিল সেইসময়ই যেহেতু প্রচলিত ধর্মগুলো সব ধরণের মানুষকে বাস্তবের বেদনা থেকে উদ্ধারের পথ দেখাতেও পারছিল না আবার বাস্তব ভুলে থাকতে পারার মত নেশাও ধরাতে পারছিল না I ফলত এই ধর্মের ঈশ্বর বনে যাওয়া শচীনের পক্ষে প্রায় অনিবার্য ছিল I হয়ত এটা এড়ানো যেত, যদি কপিল দেব তখনও মধ্যগগনে থাকতেন বা ১৭-১৮ বছরের রাহুল দ্রাবিড় স্বভাবসিদ্ধ নিপুণতায় মার্ভ হিউজ, ম্যাকডারমটকে পার্থে নির্বিষ করে দিতে পারতেন I সেক্ষেত্রে একক রক্ষাকর্তা হিসাবে শচীনের চেহারাটা আবালবৃদ্ধবনিতার মনে এভাবে গেঁথে যেত না I ব্যাটসম্যান শচীনের তাতে ভালই হত I কিন্তু যে দেশ যে সমাজ থেকে তিনি উঠে এসেছেন তার প্রভাব এড়াবেন কি করে ? তিনি তো আর সত্যিই ভগবান নন I
কিন্তু এই আরোপিত দেবত্ব থেকে তো শচীনের  মুক্তি হতেই পারত, এমন তো নয় তিনি কখনও ব্যর্থ হননি, কিন্তু হল না I মুশকিল হল যখন তিনি ব্যর্থ হয়েছেন তখন অন্যরা আরো বেশি ব্যর্থ, আর যখন তিনি সফল তখনও অন্যদের সাথে তাঁর পার্থক্য স্পষ্ট I এবং ইতিহাস, যে কিছুতেই শচীনের পিছু ছাড়েনি I ১৯৯১ তে দেশে নরসিমা রাও সরকার I একদিকে দেশে উদারীকরণের ঢেউ উঠছে, অন্যদিকে রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ নিয়ে দেশ আরো বিভক্ত হচ্ছে I শচীনের রথ যে গতিতে ক্রিকেটবিশ্ব পরিক্রমা করেছে ঐসময়, প্রায় তেমনভাবেই এগিয়েছে লালকৃষ্ণ আদবানির রথও I সেই দ্বিধাবিভক্ত দেশে, প্রতিদিন বদলে যাওয়া দেশে, পাশের মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানোর দিনে মাঠের মধ্যে সবচেয়ে ধারাবাহিক যে মানুষটা, তাঁকেই সকলের "আমার লোক" মনে করায় কল্পনাবিলাস আছে, অসহায়তা আছে কিন্তু অন্যায় নেই I আসলে শচীন যতটা জনতার নায়ক তার চেয়েও বেশি প্রত্যেক ভারতীয়ের ব্যক্তিগত সঙ্গী I
১৯৯২ এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়াতে গোহারা সিরিজে শচীন স্মরণীয় শতরান করলেন সিডনি আর পার্থে I সেবছরই ৬ ডিসেম্বর গজনীর মামুদের মত উল্লাসে আদবানি, উমা ভারতীরা নাচলেন বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়ে I আজহারের ভারত তখন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ব্যস্ত এবং যথারীতি দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে I টেস্ট সিরিজ ০-১ হারলেও একদিনের সিরিজে ভারতকে দুরমুশ করে ৫-২ জেতে কেপলার ওয়েসেলসের দল I টেস্টে একটা শতরান করলেও এই সফরে শচীন মোটের ওপর ব্যর্থ, দলও তাই I
মনে করুন সেই ডিসেম্বর-জানুয়ারির কথা --- দেশব্যাপী দাঙ্গা, গুজব, মুম্বাইতে বিস্ফোরণ I তখন একজন ভারতীয় কিসের আশায় ক্রিকেট দেখতেন টিভিতে ? একটু আনন্দ, একটা কল্পনিরাপত্তা --- "নিজের বলতে এইটুকুই তো I" আর সেই দলগত ব্যর্থতার মধ্যেও জোহানেসবার্গে শতরান করলেন সেই শচীন I
বাস্তব থেকে পালিয়েই তো ধর্মের কাছে যাই আমরা, সাময়িক আরাম পেতে I যখন এমনিতে ঘুম আসে না তখনই তো আফিমের দরকার হয় I আর ওটুকুর জন্য তো কয়েকটা ড্রাইভ আর পুলই যথেষ্ট I কারণ আমরা কেউ তখন জিতছি না, ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় মানুষ মেরে কেউ নিজের দলকে জেতাতে পারছি না I সুতরাং শচীন যখন দারুণ একটা ইনিংসের পরেও জেতাতে পারছেন না দলকে, তখন তাঁকে মনে হচ্ছে আমাদেরই একজন I এভাবেই শচীনের দেবত্ব বেড়েই চলল I তিনি কখনই ভারতবাসীর স্বর্গবাসী দেবতা নন, তিনি প্রিয়জন, সখা I যীশুর মত, মহম্মদের মত, গোকুলবাসী কৃষ্ণের মত I শচীনের মত দেবতার সুবিধা হল আমাদের ক্রমশ পরধর্মবিদ্বেষী হয়ে ওঠা দেশে তিনি সব ধর্মের মানুষের দেবতা হয়ে উঠতে পারেন I দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে সেই ১৯৯০ এর দিনগুলো থেকেই আমাদের সবাইকে একসূত্রে গাঁথতে পারে এমন জিনিসের কথা ভাবতে গেলে ক্রিকেট ছাড়া আর কিছু মনে আসেনা I
ভাবছেন তো এই ব্যাখ্যায় পরবর্তীকালেও শচীনের উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তার ব্যাখ্যা হয় না, কারণ সেইসব সংকটের দিন কেটে গেছে ? অনেকে তাই বলেন বটে I উদার অর্থনীতির ভারতে নাকি যুবসমাজ অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী কারণ এখন নাকি আমরা "21st century superpower", এখন নাকি দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে, দেশের মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আছেন I
ভারী ভালো লাগে এসব ভাবতে I কিন্তু অভিজ্ঞতা যে অন্য কথা বলে I চোখের সামনে তো দেখি উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েদের অতিসামান্য বেতনে বহুজাতিকের চাকরি করতে I এদিকে মোবাইল ফোনে কথা বলার চেয়ে ১ কিলো পেঁয়াজ কেনার খরচা এখন বেশি I এখনও কত মানুষ পানীয় জল আনতে মাইলের পর মাইল হেঁটে যান তা কি আমরা জানি না ? অনাহারের লজ্জাজনক প্রমাণ ঢাকতে কিভাবে পরিসংখ্যান বিকৃত করা হয় তা কি কারো জানতে বাকি আছে ? মোদ্দা কথা শচীন যখন শুরু করেন তার থেকে এখনকার ভারতবর্ষের যা পার্থক্য তা বহিরঙ্গে I তাঁর ভক্তরা শুধু মলে যাওয়া আর মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখা লোক নন I "বাজারের পোকা কাটা জিনিসের কেনাকাটা করে" এমন লোকেরাও শচীনভক্ত, এবং গত আড়াই দশক শচীনের মাঠের লড়াই আসলে তাঁদের একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের লড়াই I এইজন্যই নিখুঁত দ্রাবিড় কখনও শচীনের জায়গা নিতে পারলেন না ; তাঁর সাফল্যে সেই অবিশ্বাস্যতা নেই, যখন তিনি শুরু করেছেন তখন একক যুদ্ধগুলো শচীন লড়ে ফেলেছেন I লড়াকু কুম্বলেও পারলেন না, কারণ তিনি বল হাতে ভুল করলে ফিরে আসার সুযোগ পান, শচীনের মত একটা ভুলে সব শেষ --- এই দমবন্ধ করা উত্তেজনা তিনি আমাদের দিতে পারেননি I অথচ আমাদের জীবনেও তো আমরা দ্বিতীয় সুযোগ পাইনা সচরাচর I
এমন কি ছোট শহর থেকে উঠে আসা ধোনিও শচীনকে শুরু থেকে দেখা প্রজন্মের কাছে তাঁর জায়গা নিতে পারলেন না I কারণ কোটিপতি শচীন শেষপর্যন্ত হাবেভাবে মধ্যবিত্তই থেকে গেলেন I যেদিন ব্যাটে-বলে হচ্ছে না সেদিন মাথা নিচু করে প্রিয় শট ছেঁটে ফেলে খেলব ; নিজে খাই আর না খাই, মদ, সিগারেটের বিজ্ঞাপন করব না, আমার জীবনে আমার স্ত্রীই একমাত্র নারী (অন্তত লোকে তাই জানুক) --- এইসব মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ তিনি ছাড়লেন না I ফলে মহাতারকা হয়েও পাশের বাড়ির ছেলে হয়েই শচীন রইলেন I আমরা তো বরাবরই "দেবতারে প্রিয় করি / প্রিয়েরে দেবতা" I
শচীন যে সময়ে বিদায় নিচ্ছেন সেই সময়ে আমাদের ওরকম একজন দেবতার বড় দরকার I এমন একজন দেবতা (বা ব্রেখট যাকে নায়ক বলেছেন) যাঁকে দেখে আমাদের অন্তত কিছুটা সময় মনে হয় আমরা এক, দেশটা আমাদের সবার I কারণ সামনে এমন একটা নির্বাচন যেখানে আসলে এক নম্বর ইস্যু হল "ভারত কি হিন্দুদের দেশ যেখানে মুসলিম এবং অন্য সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকতে হবে নাকি ভারত সমানভাবে সকলের দেশ ?"
শচীন এমন একজন যাঁর হেলমেটে লাগানো থাকে তেরঙ্গা I এইজন্য এবং শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতার জন্য একসময় মনে করতাম শচীন উগ্র জাতীয়তাবাদী I বোধয় ঠাকরেরাও তাই-ই ভাবতেন I কিন্তু কয়েকবছর আগে যখন আমাদের "অরাজনৈতিক" তেন্ডুলকারমশাই বলে বসলেন "আমি আগে ভারতীয় তারপর মারাঠি" I তখন ভুল ভাঙল I রাজ ঠাকরে বোধয় এখনও রেগে আছেন I তিনি ব্যাট করতে যাওয়া মানেই হিন্দু বা মুসলিম নয়, মারাঠি বা পাঞ্জাবি নয়, একজন সাধারণ ভারতীয়ের ব্যাট করতে যাওয়া --- এরকম একজনকে আমাদের দরকার ছিল ভীষণ I
 বড় দুর্ভাগা সেই দেশ যে দেশের একজন নায়কের প্রয়োজন হয় এবং সেই নায়ককে খুঁজতে হয় ক্রিকেট মাঠে I